চট্টগ্রাম জেলা
চট্টগ্রাম জেলা : চট্টগ্রাম জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকা, বন-বনানীর কারণে চট্টগ্রামের মতো ভৌগোলিক বৈচিত্র বাংলাদেশের আর কোন জেলার নেই।
নামকরণের ইতিহাস :
চট্টগ্রামের প্রায় ৪৮টি নামের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে রম্যভুমি, চাটিগা, চাতগাও, রোসাং, চিতাগঞ্জ, জাটিগ্রাম ইত্যাদি। চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতভেদ রয়েছে। পণ্ডিত বার্নোলির মতে, আরবি "শ্যাত (খন্ড)" অর্থ বদ্বীপ, গাঙ্গ অর্থ গঙ্গা নদী এ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। অপর এক মত অনুসারে ত্রয়োদশ শতকে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে বার জন আউলিয়া এসেছিলেন, তাঁরা একটি বড় বাতি বা চেরাগ জ্বালিয়ে উঁচু জায়গায় স্থাপন করেছিলেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় 'চাটি' অর্থ বাতি বা চেরাগ এবং 'গাঁও' অর্থ গ্রাম। এ থেকে নাম হয় 'চাটিগাঁও'। আবার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্সের মতে এ এলাকার একটি ক্ষুদ্র পাখির নাম থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। চট্টগ্রাম ১৬৬৬ সালে মোগল সাম্রাজ্যের অংশ হয়। আরাকানীদের হটিয়ে মোঘলরা এর নাম রাখে ইসলামাবাদ। মোগলরা এর প্রশাসনিক সীমানা চিহ্নিত করে। ১৭৬০ সালে নবাব মীর কাশিম আলী খান ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এটি হস্তান্তর করেন। ব্রিটিশরা এর নাম রাখে চিটাগাং।
Fig: Chittagong_Faisal
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব এর সময় ৩৪তম বেঙ্গল পদাতিক রেজিমেন্টের ২য়, ৩য় ও ৪র্থ কোম্পানীগুলি চট্টগ্রামে মোতায়েন ছিল। ১৮ নভেম্বর রাতে উল্লিখিত তিনটি কোম্পানী বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং জেল থেকে সকল বন্দি মুক্ত করে সিপাহিরা ৩টি সরকারি হাতি, গোলাবারুদ ও ধনসম্পদ নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। তারা পার্বত্য ত্রিপুরার সীমামত্ম পথ ধরে এগিয়ে সিলেট ও কাছাড়ে পৌঁছে । দূর্ভাগ্যবশত তাদের সকলেই কুকি স্কাউটস এবং পরবর্তীকালে দশম গোর্খা রাইফেল নামে পরিচিত সিলেট লাইট ইনফ্যান্ট্রির হাতে নিহত বা বন্দি হয়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে ৭০০ যুবক কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আর্টিলারী কোরের অস্ত্রাগার ও গোলাবারুদের ভান্ডার আক্রমণ করে, টেলিফোন ও টেলিফোন অফিস দখল করে এবং ধুম নামক স্থানে রেলপথের ফিসপ্লেট উপড়ে ফেলে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় । তাছাড়া মাষ্টারদা নামে খ্যাত বৃটিশ রাজের ভীত কাপানো এ বিপ্লবীর তত্বাবধানে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নামে এক উচ্চ শিক্ষিতা বিপ্লবী নারীর নেতৃত্বে পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করে তা ধংস করে দেয়া হয়। ক্লাব ধংস করে ফেরার পথে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে মহীয়ষী এ নারী পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্নহত্যা করেন। পরবর্তীতে সূর্যসেন ইংরেজ শাসকগন কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ১৯৩৩ সালের ২০ এপ্রিল তাকে ফাঁসি দেয়া হয় ।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশগণ চট্টগ্রামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে । ফলে চট্টগ্রাম জাপানি আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়। ১৯৪২ সালের এপ্রিলে পতেঙ্গার বিমানঘাটিতে পর পর দুদিন এবং ঐ বছর ২০ ও ২৪ ডিসেম্বর পুনরায় বোমাবর্ষণ করা হয়।
ভৌগোলিক সীমানা :
- ভৌগোলিক অবস্থান : বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে ২০০৩৫’ থেকে ২২০৫৯’উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১০২৭’থেকে ৯২০২২’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বরাবর এর অবস্থান। ভৌগোলিক সীমানা : চট্টগ্রাম জেলার উত্তরে ফেনী জেলা এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে কক্সবাজার জেলা, পূর্ব দিকে বান্দরবান, রাঙামাটি, ও খাগড়াছড়ি জেলা, এবং পশ্চিমে নোয়াখালী জেলা এবং বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এছাড়া দ্বীপাঞ্চল সন্দ্বীপ চট্টগ্রামের অংশ।
জনসংখ্যা
মোট: ২২,১০,১৬২ জন, তন্মধ্যে পুরুষ:৪৮.৬৭%, এবং মহিলা: ৫১.৩৩% জন। ধর্মের বিচারে এর মধ্যে মুসলমান: ৯২.৫৫%, হিন্দু: ৭.১৮%, বৌদ্ধ: ০.০৬%, খ্রিস্টান: ০.০৭% এবং অন্যান্য: ০.১৪% রয়েছেন।
প্রশাসনিক এলাকাসমূহ :
চট্টগ্রাম জেলা ৪১ ওয়ার্ড বিশিষ্ট ১টি সিটি কর্পোরেশন, ১৪টি উপজেলা, ২৭টি থানা, ১৩টি পৌরসভা, ১৯৪টি ইউনিয়ন, ১২৬৭টি গ্রাম, ৮৯০টি মৌজা, ১৬টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত।
উপজেলা সমূহ
চট্টগ্রাম জেলা ১৪টি উপজেলা। উপজেলা গুলো হলোঃ
- আনোয়ারা
- বাঁশখালী
- বোয়ালখালী
- চন্দনাইশ
- ফটিকছড়ি
- হাটহাজারী
- লোহাগড়া
- মীরসরাই
- পটিয়া
- রাঙ্গুনিয়া
- রাউজান
- সন্দ্বীপ
- সাতকানিয়া
- সীতাকুন্ড
অর্থনীতি:
চট্টগ্রাম আমাদের দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাংলাদেশের সর্বমোট রপ্তানী বাণিজ্যের প্রায় ৭৫ ভাগ সংঘটিত হয়। অন্যদিকে আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ হার ৮০ ভাগ। রাজস্ব আয়েও চট্টগ্রামের ভুমিকা অপরিসীম। আমাদের মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ৬০ ভাগ আসে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে। বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানী প্রক্রিয়াকরন অঞ্চল হিসাবে ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রামের হালিশহরে ৪৫৩ একর জায়গার উপর নির্মাণ করা হয় চট্টগ্রাম ইপিজেড। এটা সমুদ্র বন্দর থেকে ৩.১০ কিলোমিটার এবং শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে মাত্র ১১.৩০ কিলোমিটার দুরত্বে হওয়ায় শিল্প পার্ক হিসাবে দ্রুত প্রসার লাভ করেছ। চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর।
ঐতিহাসিক স্থানসমূহঃ
- আগুনিয়া চা-বাগান - উত্তর রাঙ্গুনিয়া
- চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা
- সন্দ্বীপ সমুদ্র সৈকত
- আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ
- কমনওয়েলথ ওয়ার সেমেট্রি চট্টগ্রাম
- কালুরঘাট
- খানখানাবাদ সমুদ্র সৈকত - বাঁশখালী।
- চন্দ্রনাথ মন্দির, সীতাকুন্ড
- খিরাম সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ফটিকছড়ি।
- চেরাগী পাহাড়
- চাঁদপুর-বেলগাঁও চা বাগান, পুকুরিয়া, বাশখালী
- জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘর
- নজরুল স্কয়ার
- পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত
- পারকি সমুদ্র সৈকত, আনোয়ারা
- ফয়েজ লেক
- বাটালী পাহাড়
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
- বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি
- বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো-পার্ক, সীতাকুণ্ড
- বাঁশখালী ইকোপার্ক।
- বৌদ্ধ তীর্থ স্থান চক্রশালা পটিয়া
- ভাটিয়ারি গল্ফ ক্লাব
- ভূজপুর সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ভূজপুর, ফটিকছড়ি।
- মহামুনি বৌদ্ধ বিহার, রাউজান।
- মহামায়া সেচ প্রকল্প, মীরসরাই।
- রাঙ্গনিয়া কোদালা চা বাগান
- লালদিঘি
- লোহাগাড়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।
- শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব :
- অনিলকুমার রক্ষিত –– সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য।
- অন্বিকা চক্রবর্তী –– সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য।
- অন্নদাচরণ খাস্তগীর–– চিকিৎসক, সমাজসংস্কারক ও গবেষণামূলক প্রবন্ধকার।
- নুরুল ইসলাম –– ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব;
- অপূর্ব সেন ভোলা –– বাঙালি সাহিত্যিক।
- আবদুল করিম (সাহিত্যবিশারদ)–– জাতীয় অধ্যাপক, চিকিৎসক।
- নির্মলকুমার সেন –– ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব।
- তাজুল ইসলাম–– বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
- কালীপদ ভট্টচার্য –– সাহিত্যিক।
- পূর্ণিমা (অভিনেত্রী) –– (রোসাংগিরি) চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
- কবির আহম্মদ–– বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
- জামাল নজরুল ইসলাম –– চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত গবেষক ও বিজ্ঞানী।
- নভেরা আহমেদ –– একুশে পদক প্রাপ্ত ভাস্কর।
নদ-নদী :
এখানকার প্রধান নদীর মধ্যে কর্ণফুলী নদী, হালদা নদী, সাঙ্গু নদী, এবং মুহুরী নদী উল্লেখযোগ্য।
0 Comments