সিলেট জেলা
সিলেট জেলা : সিলেট জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল সিলেট । এটি সিলেট বিভাগের অধিক্ষেত্রভুক্তি একটি জেলা । সিলেট বাংলাদেশের উওর-পূর্বে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ । বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত এ জেলা দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত। জৈন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য, জাফলং এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, ভোলাগঞ্জের সারি সারি পাথরের স্তূপ পর্যটকদের টেনে আনে বার বার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সিলেট জেলার বিপুল সংখ্যক লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসন গ্রহণ করেছে তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখে। সিলেটের পাথর, বালির গুণগতমান দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। জেলার প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে যা সারা দেশের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ জেলার ভূমিকা অপরিসীম। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম,এ,জি ওসমানী এ জেলারই কৃতী সন্তান।
১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে এ অঞ্চল ব্রিটিশদের করায়ত্ত হবার পর ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে সিলেট জেলার সৃষ্টি হয় এবং প্রথম কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান মিঃ উইলিয়াম থ্যাকারে । ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এক পর্যায়ে সিলেট জেলাকে ভেঙ্গে চারটি জেলা সৃষ্টি করা হয় । স্বাধীনতাপূর্ব সদর মহুকুমার এলাকা নিয়ে বর্তমানে সিলেট জেলা গঠিত । ১২(বার)টি উপজেলা নিয়ে বর্তমান সিলেট জেলা গঠিত।
সিলেট জেলার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা হলো সিলেট শহর । ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেই সিলেট দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। সিলেট পৌরসভা সৃষ্টি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে । ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন এক মারাত্মক ভূমিকম্প গোটা সিলেট শহরটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তী কালে ধ্বংসস্ত্তপের ওপর গড়ে উঠে ইউরোপীয় ধাঁচের আরও সুন্দর ও আধুনিক শহর। ১৮৯০ এর দশকের শেষ ভাগে বেশ কিছু রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়। ১৯১২-১৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটি শাখা সিলেটের সাথে সংযুক্ত হলে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সিলেটের বিচ্ছিন্নতার প্রকৃত অবসান ঘটে। চা শিল্পের কারণে বিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে প্রবাসী সিলেটীদের কল্যানে সিলেটের শহর দ্রুত নগরায়ণ ঘটতে থাকে এই নগরায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
নামকরণের ইতিহাস :
সিলেটের আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ অনুসারে এই অঞ্চলের প্রাচীন সীমানার যে উল্লেখ পাওয়া যায় সে অনুসারে তৎকালীন শ্রীহট্টমণ্ডল বর্তমান সিলেট বিভাগে র চেয়ে আয়তনে অনেক বড় ছিল, এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান সরাইল বা সতরখণ্ডল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত), জোয়ানশাহী (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত), ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অনেকাংশ শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ কামাখ্যা তন্ত্র অনুযায়ী প্রাচীন কামরুপ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমাই প্রাচীন শ্রীহট্ট ছিল অর্থাৎ শ্রীহট্ট ছিল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত। যোগিনী তন্ত্রে শ্রীহট্টের সীমার বিবরণ এরকম: পূর্ব্বে স্বর্ণ নদীশ্চৈব দক্ষিণে চন্দ্রশেখর লোহিত পশ্চিমে ভাগে উত্তরেচ নীলাচল এতন্মধ্যে মহাদেব শ্রীহট্ট নামো নামতা। অতপর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পরবর্তি সময়ে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক রুপরেখার বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে সিলেট বিভাগের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ ত্রিপুরা রাজ্যের আধিকার্ভুক্ত এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের অনেক অংশ হারিকেল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অবশিষ্টাংশে শ্রীহট্টের প্রাচীন রাজ্য জয়ন্তীয়া, লাউড় ও গৌড় বিস্তৃত ছিল। [৬] দশম শতাব্দীতে মহারাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক উৎকীর্ণ পশ্চিমবাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি সিলেট জয় করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, সিলেট বা শ্রীহট্ট(সমঋদ্ধ হাট) বহু আগে থেকেই একটি বর্ধিষ্ণু বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বর্তমান ছিল। প্রাচীন শ্রীহট্টে বিপুল হারে বাঙালি অভিবাসন হয়েছিল। ১৪ শতকে ইয়েমেনের সাধক পুরুষ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) সিলেট জয় করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। মুগল যুগে পাঠান বীর খাজা ওসমান সিলেটের স্থানীয় সামন্তদের সহায়তায় আক্রমণকারী যুগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। সুলতানী আমলে সিলেটের নাম ছিল জালালাবাদ। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের সময়ে সিলেটে বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্যর্থ হয়। নানকার বিদ্রোহ সিলেটের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নানকাররা ছিল জমিদারদের ভূমিদাস। নানাকার বিদ্রোহ সহ আরও কয়েকটি বিদ্রোহ সংঘটিত হলে ১০৫০ সালে এ প্রথা বিলুপ্ত করা হয়।
ভৌগোলিক সীমানা :
- সিলেট জেলার ভৌগোলিক অবস্থান ২৪০ ৪০’ থেকে ২৫০ ১১’’ উত্তর অক্ষাংশ ৯১০ ৩৮’’ থেকে ৯২০ ৩০’’ দ্রাঘিমাংশ। সিলেট জেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় ও খাশিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়, পূ্র্বে ভারতের আসাম , দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা ও পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা অবস্থিত। এই জেলার আয়তন ৩,৪৯০.৪০ বর্গ কিমি। বাৎসরিক সর্বচ্চো তাপমাত্রা ৩৩.২° সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৩.৬° সেলসিয়াস। বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ৩৩৩৪ মিলিমিটার। প্রধান নদীসুরমা ও কুশিয়ারা। হাওড় সংখ্যা ৮২ টি। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ২৩৬.৪২ বর্গ কিলোমিটার। ভারতের খাশিয়া-জয়ান্তা পাহারের কিছু অংশ এই জেলায় পরেছে। এছাড়াঅ কিছু ছোট পাহার ও টিলা রয়েছে এখানে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জৈন্তাপুর (৫৪ মাইল), সারি টিলা (৯২ মাইল), লালখান টিলা (১৩৫ মাইল), ঢাকা দক্ষিণ টিলাসমুহ (৭৭.৭ মাইল)।প্রশাসনিক এলাকাসমূহ :
- ১৭৮২ সালের ৩ জানুয়ারি সিলেট জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা ছিল ঢাকা বিভাগের অর্ন্তভূক্ত। ঐ বছরেরই ১২ সেপ্টেম্বর নবসৃষ্ট আসাম প্রদেশের সাথে সিলেটকে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ এর আগ পর্যন্ত (১৯০৫-১৯১১ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ সময়ের কালটুকু বাদ দিয়ে) সিলেট আসামে,র অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভিক্তির সময় গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এর সাথে সম্পৃক্ত হয়। তখন প্রশাসনিকভাবে সিলেট ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের অর্ন্তভূক্ত। ১৯৮৩-৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন এর সময় বৃহত্তর সিলেট জেলাকে ০৪(চার)টি নতুন জেলায় বিভক্ত করা হয়। [৪] সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলা গুলো হল:
- বালাগঞ্জ উপজেলা
- বিয়ানীবাজার উপজেলা
- বিশ্বনাথ উপজেলা
- কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা
- ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা
- গোলাপগঞ্জ উপজেলা
- গোয়াইনঘাট উপজেলা
- জৈন্তাপুর উপজেলা
- কানাইঘাট উপজেলা
- সিলেট সদর উপজেলা
- জকিগঞ্জ উপজেলা
- দক্ষিণ সুরমা উপজেলা
এছাড়াও এই জেলার ১৩ টি থানা, ৪টি পৌরসভা, ১টি সিটি কর্পোরেশন, ১০১টি ইউনিয়ন, ১৬৯৩টি মৌজা, ৩৪৯৭ টি গ্রাম, ৪৯২৮৩৩ টি পরিবার রয়েছে।
চিত্তাকর্ষক স্থান ও পর্যটন আকর্ষণঃ
হযরত শাহজালাল (রাঃ) ও হযরত শাহ পরান (রাঃ) এর পবিত্র মাজার শরীফ এ জেলায় অবস্থিত। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ লোক মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করে। আসে বিপুল সংখ্যক পর্যটক। সিলেট এর স্থানীয় ভাষা ‘‘নাগরী ভাষা’’র একটি বিশেষত্ব রয়েছে যা অন্য অঞ্চল থেকে পৃথক। শীত মৌসুমে সিলেটের হাওর-বাওর গুলো ভরে উঠে অতিথি পাখির কলরবে।
- 1. জাফলং
- 2. ভোলাগঞ্জ
- 3.লালাখাল
- 4.তামাবিল
- 5.হাকালুকি হাওড়
- 6.ক্বীন ব্রীজ
- 7. হযরত শাহজালাল(রাঃ) হযরত শাহ পরাণ(রাঃ) এর মাজার শরীফ
- 8. মহাপ্রভু শ্রী চৈত্যনো দেবের বাড়ী
- 9. হাছন রাজার মিউজিয়াম
- 10. মালনী ছড়া চা বাগান
- 11. ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর
- 12. পর্যটন মোটেল
- 13. জাকারিয়া সিটি
- 14.ড্রিমল্যান্ড পার্ক
- 15. আলী আমজাদের ঘড়ি
- 16. জিতু মিয়ার বাড়ী
- 17. মনিপুরী রাজবাড়ি
- 18. মনিপুরী মিউজিয়াম
- 19. শাহী ঈদগাহ
- 20. ওসমানী শিশু পার্ক
- 21.মাধবকুন্ড জলপ্রপাত
- 22. সৈয়দপুর গ্রাম
- 23.সিলেটী নাগরী লিপি
- 24.পাংতুমাই
- 25.রাতারগুল
- 26.টাংগুয়ার হাওর
- 27. লোভাছড়া
- 28. হাম হাম জলপ্রপাত
- 29. পরীকুন্ড ঝর্ণা
- 30. সাতছড়ি উদ্যান
- 31. হারং হুরং
- 32. বরাক নদীর তিন মোহনা
অর্থনীতি :
সিলেট একটি প্রবাসীবহুল জনপদ। যুক্ররাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিলেট বিভাগের মানুষের বসবাস রয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা এই বিভাগের প্রধান উত্স যেমন; চা, ধান , মাছ , কমলা, লেবু , আনারস , বাশঁ, আম, ইত্যাদি এই অঞ্চলের মানুষের অনন্য অবলম্বন [এছাড়া সিলেট পর্যটন এলাকা হিসেবে প্রসিদ্ধ। পর্যটন খাত থেকেও প্রচুর মুদ্রা অর্জন করে সিলেট।
প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব :
- সিলেট জেলার কৃতি ব্যক্তিবর্গের বিস্তারিত তালিকা দেখুন।
- এম সাইফুর রহমান (১৯৩২- ২০০৯)
- জেনারেল এম,এ,জি ওসমানী
- আল্লামা নূরউদ্দীন আহমদ (র.)
- আবুল মাল আব্দুল মুহিত
- নুরুল ইসলাম নাহিদ
- ডঃ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধূরী
- বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী
- গোবিন্দ চন্দ্র দেব (১৯০৭-১৯৭১)
- কবি প্যারীচরন দাস-(১৮৫০-১৮৯০)
- সুহাসিনী দাস
- খান বাহাদুর এহিয়া চৌধুরী -(১৮৫১-১৯২৫)
- হেনা দাস
- জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অবঃ)আবদুল মালিক
- শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৫-১৫৩৩)
- আবদুল ওহাব চৌধুরী (১৭৬৩-১৮৮৮)
- শীতালং শাহ (১৮০৬-১৮৯৯)
- রাজা গিরিশচন্দ্র রায় (১৮৪৫-১৯০৮)
- শরচ্চন্দ্র চৌধুরী (১৮৫১-১৯২৭)
- হাফিজ মোহাম্মদ হাতিম চৌধুরী (১৮৫৫-১৯২৫)
- বাধানাথ চৌধুরী (১৮৫৬-১৯৯২)
- সুন্দরীমোহন দাস (১৮৫৭-১৯৫০)
- মৌলভী আবদুল করিম (১৮৬৩-১৯৪৩)
- অচ্যুতচরণ চৌধুরী (১৮৬৫-১৯৫৩)
0 Comments