ফেনী জেলা

Feni District of Chittagong Division in Bangladesh  
ফেনী জেলা : ফেনী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।

নামকরণের ইতিহাস :


ফেনী নদীর নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ফেনী।[৪] মধ্যযুগে কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় একটি বিশেষ নদীর স্রোতধা ও ফেরী পারাপারের ঘাট হিসেবে আমরা ফনী শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীর সময়ে কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগলপুরের বর্ণনায় উল্লেখ করেন: "ফনী নদীতে বেষ্টিত চারিধার, পূর্বে মহাগিরি পার নাই তার।" এরপর সতের শতকে মির্জা নাথানের ফার্সী ভাষায় রচিত বাহরিস্তান-ই-গায়েবীতে ফনী শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ফেনী-তে পরিণত হয়।[৫] আঠার শতকের শেষার্ধে কবি আলী রেজা প্রকাশ কানু ফকির তার পীরের বসতি হাজীগাওর অবস্থান সম্পর্কে লিখছেন, "ফেনীর দক্ষিণে এক ষর উপাম, হাজীগাও করিছিল সেই দেশের নাম।" কবি মোহাম্মদ মুকিম তার পৈতৃক বসতির বর্ণনাকালে বলেছেন, "ফেনীর পশ্চিমভাগে জুগিদিয়া দেশে।" তারাও নদী অর্থে ফেনী ব্যবহার করেছেন। ধারণা করা হয় আদি শব্দ ‘ফনী’ মুসলমান কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় ফেনীতে পরিণত হয়েছে।
দূর অতীতে এ অঞ্চল ছিল সাগরের অংশ; তবে উত্তর পূর্ব দিক ছিল পাহাড়িয়া অঞ্চলের পাদদেশ।ফেনীর পূর্বদিকের রঘুনন্দন পাহাড় থেকে কাজির বাগের পোড়ামাটি অঞ্চলে হয়তঃ আদিকালে শিকারী মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পড়েছিল।এখানকার ছাগলনাইয়া গ্রামে ১৯৬৩ সালে একটা পুকুর খননকালে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহৃত একটা হাতিয়ার বা হাতকুড়াল পাওয়া গেছে।পন্ডিতদের মতে ঐ হাতকুড়াল প্রায় পাচ হাজার বছরের পুরাতন।[৬] বৃহত্তর নোয়াখালীর মধ্যে পূর্বদিকের ফেনী অঞ্চলকে ভূ-খন্ড হিসেবে অধিকতর প্রাচীন বলে পন্ডিতগণ মত প্রকাশ করেছেন। ফেনীর পূর্বভাগের ছাগলনাইয়া উপজেলার শিলুয়া গ্রামে রয়েছে এক প্রাচীন ঐতিহাসিক শিলামূর্তির ধ্বংসাবশেষ।প্রকাশ শিলামূর্তির অবস্থানের কারণে স্থানটি শিলুয়া বা শিল্লা নামে পরিচিত হয়েছে।প্রাচীন কালে হয়ত এখানে বৌদ্ধ ধর্ম ও কৃষ্টির বিকাশ ঘটেছিল।[৭]

ডঃ আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের ইতিকথায় বলেছেনঃ প্রাচীনকালে আধুনিক ফেনী অঞ্চল ছাড়া নোয়াখালীর বেশির ভাগ ছিল নিম্ন জলা ভূমি। তখন ভুলুয়া (নোয়াখালীর আদি নাম) ও জুগিদিয়া (ফেনী নদীর সাগর সঙ্গমে অবস্থিত) ছিল দ্বীপের মতো। [৮] ছাগলনাইয়া নামকরণ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন যে ইংরেজ আমলের শুরুতে সাগর (Sagor) শব্দটি ভুল ক্রমে সাগল (Sagol) নামে লিপিবদ্ধ হয়েছিল।তাই ছাগল নাইয়া শব্দটি প্রচলিত হয়ে ওঠে।উল্লেখ্য ইংরেজ আমলের পূর্বে কোন পুথি পত্রে ছাগল নাইয়া নামের কোন স্থানের নাম পাওয়া যায় না।[৭]
ফেনী নদীর তীরে রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বীর বাঙ্গালী শমসের গাজীর রাজধানী ছিল। তিনি এখান থেকে যুদ্ধাভিযানে গিয়ে রৌশনাবাদ ও ত্রিপুরা রাজ্য জয় করেন। তিনি চম্পক নগরের একাংশের নামকরণ করেছিলেন জগন্নাথ সোনাপুর।[৭] ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে যে সকল মহকুমাকে মানোন্নীত করে জেলায় রূপান্তর করা হয়েছিল ফেনী জেলা তার একটি। জেলাটির আয়তন ৯২৮.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৮৪ সালের পূর্বে এটি নোয়াখালী জেলার একটি মহকুমা ছিল। এ মহকুমার গোড়াপত্তন হয় ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে মিরসরাই, ছাগলনাইয়া ও আমীরগাঁও এর সমন্বয়ে। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন কবি নবীন চন্দ্র সেন। ১৮৭৬ সালে মিরসরাইকে কর্তন করে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভক্ত করা হয়। প্রথম মহকুমা সদর দপ্তর ছিল আমীরগাঁওয়ে।১৮৭২ থেকে ১৮৭৪ সালের মধ্যে মোগল আমলের আমীরগাও থানা নদী ভাঙ্গনের ফলে ফেনী নদীর ঘাটের কাছাকাছি খাইয়ারাতে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তীতে এটি ফেনী থানা নামে পরিচিত হয়। অতঃপর ১৮৭৬ সালে নতুন মহকুমার পত্তন হলে খাইয়ারা থেকে থানা দপ্তরটি মহকুমা সদরে স্থানান্তরিত হয় ও নতুন মহকুমাটি ফেনী নামে পরিচিত হয়।[৬] পরবর্তীতে ১৮৮১ সালে তা ফেনী শহরে স্থানান্তরিত হয়।

ভৌগোলিক সীমানা :


চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনস্থ ফেনী জেলার মোট আয়তন ৯২৮.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। এর উত্তরে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা, পশ্চিম-দক্ষিণে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা, পূর্ব-উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা এবং পূর্ব-দক্ষিণে চট্রগ্রামের মীরসরাই উপজেলা অবস্থিত।

জনসংখ্যা

• মোট ১৪,৯৬,১৩৮ • ঘনত্ব ১৬০০/কিমি২ (৪২০০/বর্গমাইল)

প্রশাসনিক এলাকাসমূহ :


ফেনী জেলায় ৬টি উপজেলা, ৬টি থানা, ৫টি পৌরসভা, ৪৩টি ইউনিয়ন, ৫৬৪টি গ্রাম এবং ৫৪০টি মৌজা রয়েছে।
উপজেলাসমূহঃ
    • ফেনী সদর উপজেলা
    • ছাগলনাইয়া উপজেলা
    • সোনাগাজী উপজেলা
    • ফুলগাজী উপজেলা
    • পরশুরাম উপজেলা
    • দাগনভূঁইয়া উপজেলা

পৌরসভাসমূহঃ
ফেনী জেলায় ৫ টি পৌরসভা রয়েছে
  • ফেনী পৌরসভা
  • দাগনভূঁইয়া পৌরসভা
  • সোনাগাজী পৌরসভা
  • ছাগলনাইয়া পৌরসভা
  • পরশুরাম পৌরসভা

অর্থনীতি:


ফেনী জেলার অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। জেলার মধ্যদিয়ে কয়েকটি নদী প্রবাহিত হওয়ার ফলে এর কৃষি জমি সমূহ বেশ উর্বর। এছাড়া এ অঞ্চলের অনেক লোক বিদেশ থাকার ফলে প্রচুর পরিমাণ বৈদিশিক আয় এ জেলার অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে।বর্তমানে অনেক কলকারখানা এখানকার অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ ব্যাবস্থাকে সমৃদ্ধ ও সমুন্নত করছে।

মুক্তিযুদ্ধে ফেনী জেলা:


১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ফেনী জেলার (তৎকালীন ফেনী মহুকুমার) স্বাধীনতাকামী জনগনের রয়েছে অভাবনীয় বীরত্বগাথা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে তিন দিক থেকে ফেনীর রয়েছে সীমান্ত। ফলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ফেনীতে ব্যাপক অত্যাচার নিপীড়ন চালায়। ফেনী সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে শুভপুর ও বিলোনিয়া যুদ্ধ অন্যতম। তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা ফেনী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম আব্দুল মালেক ( যুদ্ধকালীন সময়ে বি এল এফ এর প্রেসিডেন্ট) ও মরহুম খাজা আহমদের নেতৃত্বে ফেনীর মুক্তিযোদ্ধারা দেরাদুন ও চোত্তাখোলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার জাফর ইমামের নেতৃত্বে বিলোনিয়া যুদ্ধ একটি অনন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
বিএলএফের ফেনী মহুকুমা কমান্ডার হিসাবে ভিপি জয়নাল ফেনীর পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখেন। ৬ ডিসেম্বর ফেনী জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ফেনীকে মুক্ত করেন। প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর দিনটিকে ফেনী জেলাবাসী "ফেনী মুক্ত দিবস" হিসেবে পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে দেওয়া হয়। খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪ জন বীর উত্তম, ৭ জন বীর বিক্রম এবং ২০ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।

ঐতিহাসিক স্থানসমূহঃ


  • ফেনী নদী
  • সাতসতি
  • সিলোনীয়া নদী, ফেনী
  • বিজয় সিংহ দীঘি, মহিপাল, ফেনী
  • রাজাঝির দীঘি, ট্রাঙ্ক রোড, ফেনী
  • কৈয়ারা দিঘী
  • পরীর দিঘী
  • শমসের গাজীর দিঘী, ছাগলনাইয়া
  • মুহুরি প্রজেক্ট
  • জগন্নাথ কালী মন্দির, ছাগলনাইয়া
  • হিন্দু জমিদার বাড়ীর সাত মন্দির, ছাগলনাইয়া
  • শিলুয়ার শীল পাথর
  • বাউরখুমা আশ্রয়ন প্রকল্প, পরশুরাম
  • সার্কিট হাউজ
  • ভাষা শহীদ সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, দাগনভুঁইয়া

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব :


  • সেলিম আল দীন - নাট্যকার ও গবেষক।
  • সুমাইয়া কাজী - নারী উদ্যোক্তা।
  • শহীদুল্লাহ কায়সার - লেখক ও বুদ্ধিজীবী।
  • ফয়জুল মহিউদ্দিন - শহীদ বুদ্ধিজীবী।
  • সিরাজুল হক খান - শহীদ বুদ্ধিজীবী।
  • সেলিনা পারভীন - শহীদ বুদ্ধিজীবী।
  • জাফর ইমাম - মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রী।
  • বঙ্গবীর শমসের গাজী - ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী
  • আমীন আহম্মেদ চৌধুরী - মুক্তিযোদ্ধা।
  • কাইয়ুম চৌধুরী - চিত্রশিল্পী।
  • গিয়াস কামাল চৌধুরী - সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সংবাদ বিশ্লেষক।
  • জহুর হোসেন চৌধুরী - সাংবাদিক।
  • ওয়াসফিয়া নাজরীন- পর্বতারোহী, এভারেস্ট বিজয়ী ২য় বাঙালি নারী।
  • সালাহউদ্দিন মমতাজ - মুক্তিযোদ্ধা
  • খালেদা জিয়া - বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। বতর্মান বিরোধী দলীয় নেত্রী।
  • শামসুন নাহার মাহমুদ - নারী মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী।
  • জহির রায়হান - চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার।
  • আবদুস সালাম - ভাষা শহীদ
  • আবদুস সালাম - বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম মহাপরিচালক।
  • স্যার এ এফ রাহমান - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙ্গালী উপাচার্য।