অবস্থান: শাহবাজপুর ইউনিয়ন, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
|
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে (গৌড়ের পূর্বাঞ্চলে) ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব যারা বহন করেছিলেন তাদের মধ্যে স্বনাম খ্যাত সাধক হযরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহ (রহঃ) অন্যতম। সুলতান শাহ সুজার রাজত্বকালে (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিঃ) তিনি দিল্লী প্রদেশের করোনিয়ার নামক স্থান থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নানা স্থান ভ্রমন করে রাজমহলে এসে উপস্থিত হন। তার আগমনবার্তা জানতে পেরে শাহ সুজা তাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান এবং তার নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। পরে তিনি গৌড়ের উপকন্ঠে (শিবগঞ্জ উপজেলার) ফিরোজপুরে স্থায়ীভাবে আস্তানা স্থাপন করেন। দীর্ঘদিন এতদঞ্চলে তিনি সুনামের সঙ্গে ইসলাম প্রচার করে ফিরোজপুরেই ১০৭৫ হিজরী (১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে) মতান্তরে ১০৮০ হিজরীতে (১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে) সমাধিস্থ হন। পারস্য দেশীয় একটি বিবরণীতে হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি একজন জবরদস্ত আলেম ও আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন। ষোড়শ শতকের শ্রেষ্ঠ আওলিয়াগণের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। তাহখানা প্রাসাদটি শাহ সুজা, শাহ নেয়ামতউল্লাহর বসবাসের জন্য প্রদান করেন। পরে তিনি সেখানে একটি ৩ গমবুজ মসজিদ নির্মান করেন এখনও তা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।
হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধর ও পুরুষানুক্রমিক ওলী ছিলেন। তিনি হাকিকাত ও মারেফাতের শ্রেষ্ঠ কামেল দরবেশ ছিলেন। তাঁর মত একজন ধর্মনিষ্ঠ আউলিয়া যাতে আজীবন নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম ও মুসলমানের সেবা এবংরাজ্যের উন্নতি করতে পারেন -সেজন্য বাদশাহ আলমগীর মহিউদ্দিন আওরঙ্গজেব সুবায়ে বাঙলা সরকার জান্নাতাবাদে পরাগণে ‘দারাশাকে’ ৫,০০০/- টাকা আয়ের সম্পত্তি তার ও তার বংশধরদের ভরণপোষণের জন্য দান করেন। তিনি প্রায় ৩৩ বছর এই সম্পত্তির আয় থেকে এই মসজিদ ও খানকার যাবতীয় খরচাদি নির্বাহ করে গেছেন। তার মৃত্যুর পরও অনেকদিন পর্যন্ত সম্পত্তির আয় হতে খানকা ও মসজিদের জন্য ব্যয় হতো।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমানটি নিম্নরূপঃ‘‘যেহেতু (সুলতানের) উদার ও ধার্মিক অন্তরে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ এবং নবীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সাঈদদের আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা পূরণের অভিলাষ গভীরভাবে বদ্ধমূল, সেজন্য এই শুভ সময়ে সাঈদ ও আমীরবৃন্দের এবং যার হাকিকাত ও মারিফাতের (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) সাথে সুপরিচিত, তাদের আশ্রয়স্থল শাহ নেয়ামতউল্লাহর প্রতি রাজকীয় দানশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। কল্যাণ ও দয়ার আশ্রয় থেকে এই মর্মে একটি মহান ফরমান জারী করা হয়েছে যে, শরৎকালীন ফসলের শুরু থেকে বাংলা সুবার (প্রদেশ) জান্নাতাবাদ সরকারের দরসড়ক পরগানা থেকে ৫০০০/- টাকা তার বংশধরগণের ভরণপোষণের জন্য মঞ্জুর করা হলো। যাতে তিনি আরাম আয়েশে জীবন যাপন করতে পারেন এবং সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করতে পারেন। সমস্ত রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ এই রাজকীয় আদেশ স্থায়ী বিবেচনা করবেন এবং সে পরগণার যে সব মৌজার আয় ৫,০০০/- টাকা সেগুলো তার নিকটে তার ভরণপোষণের নিমিত্তে হস্তান্তর করতে হবে। পরলোকগত সুলতানের এটি সাবেক ফরমান দ্বারা দরবেশকে যে মদদ-ই-মাশের (খরচ) মঞ্জুরী দেয়া হয়েছিল, উপরোক্ত অর্থ এর অতিরিক্ত বিবেচনা করতে হবে। ফরমানের মধ্যে উল্লেখ নেই এমন কিছু (অর্থাৎ মঞ্জুরী) বাতিল বলে গণ্য করতে হবে। মূল ফরমানটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই ফরমানটি যা রবিউস সানি ১০৭৭ হিজরীতে প্রতিপালিত হয়েছে বলে সম্রাটকে জানানো হয় এবং শাহজাহানের ১৬ই রবিউস সানি, ১০৪৩ হিজরী তারিখে পূর্বতন ফরমানটি এই উভয় ফরমানের সত্যায়িত অনুলিপি মালদহ কালেকটরেটে পাওয়া যায়। গৌড়ের ফিরোজপুরে যে, পতিত জমি সৈয়দ শাহ নেয়ামতউল্লাহ চাষের অধীনে এনেছিলেন এবং যার আয় থেকে তিনি সেখানে তার নির্মিত একটি মসজিদ ও খানকার ব্যয় নির্বাহ করতেন, পূর্বতন আদেশটি দ্বারা তার উপর যে কোন ধরণের কর আরোপে নিষিদ্ধ করা হয়। ফরমান দুটির তারিখ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, দরবেশ অন্তত ৩৩ বছর ফিরোজপুরে বসবাস করেন এবং তার মৃত্যুর তারিখ ১০৮০ হিজরী।
শাহ নেয়ামতউল্লাহর সমাধিঃ
হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহর মাজার শরীফ শিবগঞ্জ উপজেলার তোহাখানায় অবস্থিত। বার দরজা বিশিষ্ট চতুস্কোনায়তন তার সমাধিটি। প্রত্যেক পাশে ২/৩ টি করে দরজা আছে। এখানে যে লিপিটি আছে তা হোসেন শাহী যুগের একটি আরবী লিপি। পরবর্তীকালে তা স্থাপন করা হয়েছে। এই সমাধি প্রাঙ্গণে আরো কয়েকজন সাধক, তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গের সমাধি রয়েছে। হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহর সমাধি প্রাঙ্গন বৃক্ষশোভিত ও ইটের প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত। প্রতিদিনই বহুলোক তার মাজার দর্শন করে কৃতার্থ হন। পহেলা মহরম হযরত শাহ নোয়ামতউল্লাহর জন্ম ও মৃত্যুর দিন বলে পরিচিত। এই দিনে প্রতিবছরই এখানে ‘উরস পালন’ করা হয়ে থাকে। এছাড়া ভাদ্র মাসের শেষ শুক্রবার এখানে অন্য একটি উরস পালন করা হয়। এ দিনই অধিকাংশ লোক এখানে জমায়েত হয়ে থাকেন। এ দিনেরই ফজিলত বেশি বলে অনেকের ধারনা। হযরত এদিনে ইসলাম প্রচারের জন্য সর্বপ্রথম গৌড় নগরীতে পদার্পন করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবারের দিন আসরের নামাজের পর সারারাত ব্যাপী ‘জেকের’ অনুষ্ঠিত হয়। উরস কমিটির পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মিলাদ শরীফ পাঠ করান হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসককে পদাধিকার বলে সভাপতি করে একটি ‘মাজার পরিচালনা কমিটি‘ গঠিত রয়েছে। এতে ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ী, সরকারী কর্মচারী ছাড়াও বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সদস্য রয়েছেন। শুক্রবার বাদ জুম্মা হযরতের মাজারে চাদরপশী বা গিলাফ পরানো হয়। এই চাদর প্রদান করেন পীর সাহেবের বংশধর নবাবগঞ্জ নিবাসী আলহাজ্ব শাজাহান আলী । তিনি পীর সাহেবের কন্যা কাদিরণ নেসার বংশধর।
কিভাবে যাওয়া যায়: চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি.। বাস অথবা সিএনজি-তে যাওয়া যায়। প্রায় ৪৫ মি. থেকে ১ ঘন্টা সময় লাগে।
0 Comments