নোয়াখালী জেলা

Noakhali District of Chittagong Division in Bangladesh 
নোয়াখালী জেলা : নোয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বর্তমান নোয়াখালী জেলা আগে ফেনী, লক্ষীপুর এবং নোয়াখালী জেলা নিয়ে একটি বৃহত্তর অঞ্চল ছিল, যা এখনও বৃহত্তর নোয়াখালী নামে পরিচিত।

নামকরণের ইতিহাস :


নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। ইতিহাসবিদদের মতে একবার ত্রিপুরার পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এই বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় "নোয়া (নতুন) খাল" বলা হত, এর ফলে অঞ্চলটি একসময়ে লোকের মুখেমুখে পরিবর্তিত হয়ে "নোয়াখালী" হিসাবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে।
নোয়াখালী জেলার মর্যাদা পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক এদেশে জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় থেকেই। ১৭৭২ সালে কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশে প্রথম আধুনিক জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা নেন। তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ১৯টি জেলায় বিভক্ত করে প্রতি জেলায় একজন করে কালেক্টর নিয়োগ করেন। এ ১৯টি জেলার একটি ছিল কলিন্দা। এ জেলাটি গঠিত হয়েছিল মূলতঃ নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে। কিন্ত ১৭৭৩ সালে জেলা প্রথা প্রত্যাহার করা হয় এবং প্রদেশ প্রথা প্রবর্তন করে জেলাগুলোকে করা হয় প্রদেশের অধীনস্থ অফিস। ১৭৮৭ সালে পুনরায় জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং এবার সমগ্র বাংলাদেশকে ১৪টি জেলায় ভাগ করা হয়। এ ১৪ টির মধ্যেও ভুলুয়া নামে নোয়াখালী অঞ্চলে একটি জেলা ছিল। পরে ১৭৯২ সালে ত্রিপুরা নামে একটি নতুন জেলা সৃষ্টি করে ভুলুয়াকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৎকালে শাহবাজপুর, হাতিয়া, নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড, লক্ষ্মীপুর ,ফেনী , ত্রিপুরার কিছু অংশ, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মীরসরাই নিয়ে ছিল ভুলুয়া পরগনা। ১৮২১ সালে ভুলুয়া নামে স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চল ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৬৮ সালে ভুলুয়া জেলাকে নোয়াখালী জেলা নামকরণ করা হয়।

নোয়াখালীর ইতিহাসের অন্যতম ঘটনা ১৮৩০ সালে নোয়াখালীর জনগণের জিহাদ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলন। জাতিগত সংঘাত ও দাঙ্গার পর ১৯৪৬ সালে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী জেলা ভ্রমণ করেন। বর্তমানে সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগ নামক স্থানে গান্ধীজির নামে একটি আশ্রম রয়েছে, যা "গান্ধী আশ্রম" নামে পরিচিত।

১৭৯০ সালের পর হতে নোয়াখালী জেলা বহুবার ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, টর্নেডো, সাইক্লোন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হয়। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে, যার মধ্যে নোয়াখালী জেলার অনেকে ছিলেন।

১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নোয়াখালীর মাটি রঞ্জিত হয়ে আছে। ১৫ই জুন, ১৯৭১ সালে সোনাপুর আহমদীয়া স্কুলের সম্মুখ যুদ্ধে প্রায় ৭০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট পাকবাহিনী বেগমগঞ্জ থানার গোপালপুরে গণহত্যা চালায়; নিহত হন প্রায় ৫০ জন নিরস্ত্র মানুষ। নোয়াখালী জেলা স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর।

নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী মহকুমা নিয়ে নোয়াখালী জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের অর্ন্তভূক্ত একটি বিশাল জেলা হিসেবে পরিচালনা হয়ে আসছিল। ১৯৮৪ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকল মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হলে লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলা আলাদা হয়ে যায়। শুধুমাত্র নোয়াখালী মহকুমা নিয়ে নোয়াখালী জেলা পুনর্গঠিত হয়। তখন এ জেলায় উপজেলা ছিল ছয়টি। পরবর্তীতে আরো তিনটি উপজেলার সৃষ্টি করা হয়। এবং বর্তমানে জেলায় মোট উপজেলার সংখ্যা নয়টি। হাতিয়া নামক উপজেলাটির কিছু অংশ জেলার মূল ভূখন্ডের সাথে সংযুক্ত থাকলে ও বৃহত্তর অংশ (মূল হাতিয়া) এর চর্তুদিকে মেঘনা নদী দ্বারা বেষ্টিত একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা।

ভৌগোলিক সীমানা :


চট্টগ্রাম প্রশাসনিক বিভাগের অধীন নোয়াখালী জেলার মোট আয়তন ৪২০২ বর্গ কিলোমিটার। নোয়াখালী জেলার উত্তরে কুমিল্লা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলা এবং পশ্চিমে লক্ষীপুর ও ভোলা জেলা অবস্থিত।

জনসংখ্যা

মোট জনসংখ্যা ৩১,০৮,০৮৩ জন; যার মধ্যে পুরুষ ১৪,৮৫,১৬৯ জন এবং মহিলা ১৬,২২,৯১৪ জন। পুরুষ এবং মহিলার অনুপাত ৯২ঃ১০০। ধর্মের বিচারে এর মধ্যে মুসলমান: ৯২.৫৫%, হিন্দু: ৭.১৮%, বৌদ্ধ: ০.০৬%, খ্রিস্টান: ০.০৭% এবং অন্যান্য: ০.১৪% রয়েছেন।

প্রশাসনিক এলাকাসমূহ :


নোয়াখালী জেলায় ৯টি উপজেলা, ৮ টি পৌরসভা, ৭২ টি ওয়ার্ড, ১৫৩ টি মহল্লা, ৯১ টি ইউনিয়ন, ৮৮২ টি মৌজা এবং ৯৬৭ টি গ্রাম রয়েছে।
নোয়াখালী জেলায় ৯টি উপজেলা রয়েছে। এগুলো হলো:
  • নোয়াখালী সদর
  • বেগমগঞ্জ
  • চাটখিল
  • কোম্পানীগঞ্জ
  • হাতিয়া
  • সেনবাগ
  • সুবর্ণ চর
  • সোনাইমুড়ি
  • কবিরহাট

অর্থনীতি:


নোয়াখালী জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। আঞ্চলিক জিডিপির প্রায় ৪০ % কৃষি খাত থেকে আসে এবং জেলার ৮০ ভাগ লোক এই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট। কৃষির মধ্যে মূলত মৎস্য চাষ ও মৎস্য আহরনের সাথে সবচেয়ে বেশি মানুষ জড়িত। বছরজুড়ে নৌকা তৈরি ও মেরামত, মাছ ধরা, পক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, শুটকি উৎপাদন, জাল মেরামত এর সাথে প্রায় ৬০-৭০ ভাগ শ্রমজীবী জড়িত থাকে। নিন্মভূমি অঞ্চল হওয়াতে এই জেলায় প্রচুর মৎস্যচাষ হয়ে থাকে যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। ফসল উৎপাদন মূলত বছরে একবারই হয়। শীত মৌসুমে জেলার সর্বত্ত বিশেষ করে দক্ষিনের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে রকমারি ফসলের চাষ হয়। এছাড়াও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে ও দ্বীপগুলোতে গরূ, মহিষ, ছাগল এবং ভেড়া পালন ব্যাপকতা লাভ করেছে।

নোয়াখালী জেলায় শিল্প কারখানা তেমনভাবে গড়ে উঠেনি কিন্তু নোয়াখালী জেলার অনেক ব্যাক্তি দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসাবে সুনাম অর্জন করেছেন। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছেন। নোয়াখালীর মানুষ মূলত কাজের জন্য দেশে এবং বিদেশে ব্যাপকভাবে গমন করেন। জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স পাঠানো জেলাগুলোর মধ্যে নোয়াখালী জেলা গুরূত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে।

ঐতিহাসিক স্থানসমূহঃ



  • নিঝুম দ্বীপ
  • শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম
  • বজরা শাহী মসজিদ
  • ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, চর জব্বর
  • গান্ধি আশ্রম
  • নোয়াখালী জেলা জামে মসজিদ, মাইজদী
  • নোয়াখালী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, মাইজদী
  • মাইজদী কোর্ট বিল্ডিং দীঘি, মাইজদী
  • বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, সোনাইমুড়ী
  • মহাত্মা গান্ধী জাদুঘর

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব :


  • সার্জেন্ট জহুরুল হক
  • মোহাম্মদ শহিদ উল্লাহ মুন্সী, বীর প্রতীক
  • মোহাম্মদ আবুল বাশার মুন্সী বীর বিক্রম
  • ফেরদৌসী মজুমদার
  • শমসের গাজী
  • খালেদা জিয়া
  • মুনীর চৌধুরী
  • কবীর চৌধুরী
  • কামরুল আহসান
  • আবদুল মালেক উকিল
  • ওবায়দুল কাদের
  • শহীদুল্লাহ কায়সার
  • রোজী আফসারী
  • মফিদুল হক
  • মোহাম্মদ রুহুল আমিন
  • মওদুদ আহমেদ

যাতায়াত ব্যবস্থা :


সড়ক, রেল ও নৌ পথে নোয়াখালী জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। নোয়াখালী থেকে সড়ক পথে রাজধানী ঢাকাএবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের দূরত্ব যথাক্রমে ১৫১ ও ১৩৪ কি মি। বাসই মূলত দূর যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম।