চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত এই জেলাটিকে কখনো কখনো নবাবগঞ্জ এবং চাঁপাই নামেও ডাকা হয়।। ভারত উপমহাদেশ বিভাগের আগে এটি মালদহ জেলার একটি অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে এটি মালদহ থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব পাকিস্থানে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং রাজশাহি জেলার একটি মহাকুমা হিসেবে গন্য হয়। ১৯৮৪ সালে একটি একক জেলা হিসেবে আত্তপ্রকাশ করে। অনেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কে 'আমের দেশ' বলেও জানে।

নামকরণের ইতিহাস :

চাপাইনবাবগঞ্জ নামটি সাম্প্রতিকালের। এই এলাকা ‘নবাবগঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, প্রাক-ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চল ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের বিহারভূমি এবং এর অবস্থান ছিল বর্তমান সদর উপজেলার দাউদপুর মৌজায়। নবাবরা তাঁদের পাত্র-মিত্র ও পরিষদ নিয়ে এখানে শিকার করতে আসতেন বলে এ স্থানের নাম হয় নবাবগঞ্জ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামের ইতিবৃত্ত নবাব আমলে মহেশপুর গ্রামে চম্পাবতী মতান্তরে ‘চম্পারানী বা চম্পাবাঈ’ নামে এক সুন্দরী বাঈজী বাস করতেন। তাঁর নৃত্যের খ্যাতি আশেপাশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি নবাবের প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেন। তাঁর নামানুসারে এই জায়গার নাম ‘চাঁপাই”। এ অঞ্চলে রাজা লখিন্দরের বাসভূমি ছিল। লখিন্দরের রাজধানীর নাম ছিল চম্পক। চম্পক নাম থেকেই চাঁপাই। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর (১৮৮৫-১৯৬৯ খ্রি) বাঙলা সাহিত্যের কথা গ্রন্থের প্রথম খন্ডে বর্ণিত লাউসেনের শত্রুরা জামুতিনগর দিয়ে গৌড়ে প্রবেশ করে। বর্তমান ভোলাহাট উপজেলার জামবাড়িয়া পূর্বে জামুতিনগর নামে পরিচিত ছিল। এসবের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো গবেষক চাঁপাইকে বেহুলার শ্বশুরবাড়ি চম্পকনগর বলে স্থির করেছেন এবং মত দিয়েছেন যে, চম্পক নাম থেকেই চাঁপাই নামের উৎপত্তি।

চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার সংক্ষিপ্ত তথ্য : 
আয়তন : ১৭০২.৫৬ বর্গকিলোমিটার
জনসংখ্যা : ১৬,৪৭,৫২১ জন
শিক্ষার হার : ৬৬% 
উপজেলা : ০৫ টি (চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর, নাচোল ও ভোলাহাট) 
পৌরসভা : ০৪ টি (চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, রহনপুর ওনাচোল পৌরসভা) 
ইউনিয়ন : ৪৫ টি 
নদী : ০৪ টি (পদ্মা, মহানন্দা, পুনর্ভবা ও পাগলা নদী) 

দর্শনীয় স্থান :



 নদ-নদী :

পানিশূন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের নদ-নদী. মরণ বাঁধ ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগোচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাঁধের কারণে একদিকে প্রমত্তা পদ্মা যেমন নাব্য হারিয়েছে; তেমনি দেড় যুগ ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা-তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক নদীভাঙন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদী। এখানে প্রধান নদী পদ্মা,মহানন্দা,পুনর্ভবা ও পাগলা।

পদ্মা: গঙ্গা নদী ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত হওয়ার পর থেকে পদ্মায় পানি প্রবাহ কমতে থাকে এবং বিশাল চর জেগে উঠতে থাকে। বর্তমানে পদ্মা তার পূর্বেকার রূপটি হারিয়ে ফেললেও প্রতিবছর বর্ষাকালে সে প্রলয়ঙ্কারী রূপ ধারণ করে।পদ্মা বাংলাদেশের একটি প্রধান নদী। এটি হিমালয়ে উৎপন্ন গঙ্গানদীর প্রধান শাখা এবং বাংলাদেশের ২য় দীর্ঘতম নদী।  

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর রাজশাহী এই পদ্মার উত্তর তীরে অবস্থিত। পদ্মার সর্বোচ্চ গভীরতা ১,৫৭১ ফুট(৪৭৯ মিটার) এবং গড় গভীরতা ৯৬৮ফুট(২৯৫ মিটার)। রাজা রাজবল্লভের কীর্তি পদ্মার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে ধ্বংস হয় বলে পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা।

পদ্মার প্রধান উপনদী মহানন্দা ও পুনর্ভবা। মহানন্দা উপনদীটি চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলায় এবং পুনর্ভবা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার বিভিন্ন শাখানদীর মধ্যে গড়াই, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব ইত্যাদি অন্যতম। আবার পদ্মার বিভিন্ন প্রশাখা নদীসমূহ হলো- মধুমতী, পশুর, কপোতাক্ষ ইত্যাদি। এই নদীগুলো কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, বাগেরহাট,গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালি ইত্যাদি জেলার উপর দিয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে।

মহানন্দা: জেলার ভোলাহাট উপজেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মহানন্দা নদী রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরটি মহানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত। মহানন্দা নদী ভারত ও বাংলাদেশের একটি নদী। এর উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বতের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার অংশে। এখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর পর আবার পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় প্রবেশ করে, ও পরে আবার বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জ জেলা শহরের কাছে প্রবেশ করে পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়। বৃষ্টির পানি এই নদীর প্রবাহের প্রধান উৎস। ফলে গরম কাল ও শীতকালে নদীর পানি কমে যায়, আর বর্ষা মৌসুমে নদীর দুই কুল ছাপিয়ে বন্যা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা নদীর অংশটির দৈর্ঘ্য ৩৬ কিমি।

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব :

দিয়ানতুল্লাহ চৌধুরী ওরফে লুকা চৌধুরী (১৮০১-১৯০৬): দিয়ানতুল্লাহ চৌধুরী চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম মহারাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নীল বিদ্রোহের নায়ক।

রফিক মন্ডলঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়নপুরের রফিক মন্ডল ওহাবি আন্দোলনের নেতা ছিলেন।

গিরিশ চন্দ্র সিংহঃ গিরিশ চন্দ্রসিংহ বিশাল ভূ-সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দানশীল ও সমাজসেবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

গনিতজ্ঞ প্রফেসর আব্দুর রহিম (১৮৯৫-১৯৫৮): জন্ম পৌর এলাকার খামার (বর্তমানে উপর রাজারামপুর) গ্রামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। গণিত বিষয়ক তাঁর অসংখ্য গ্রন্থ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

ড. জহুরুল হক (১৯২৩-১৯৯৮): রাজারামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।

কাজী জালাল আহমদ: ধনাঢ্য পরিারের সন্তান কাজী জালাল আহমদ সোনার চামুচ মুখে নিয়ে ভোলাহাট উপজেলায় পহেলা জানুয়ারী ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম ডাঃ কাজী আজাহার উদ্দিন। তিনি মালদা জেলা স্কুল হতে ১৯৪৬ সালে মেট্রিক ও ঢাকা বিম্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫১ সালে রসায়নে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পরে পি.এস.সি সম্পন্ন করে পাকিস্তান সরকারের সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬০ সালে পাবনার জেলা প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি যোগাযোগ সচিব , শিক্ষ সচিবসহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চাকুরীর পদ অলংকার করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি সর্বশেষ প্রতিরক্ষা সচিব হয়ে অবসর গ্রহন করেন।

কুতুব উদ্দিন: গম্ভীরার জনক।

বাবু অভয় প্রদ মুখার্জী (১৯২২-৯৯): চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবশ্রেণীর মানুষের শ্রদ্ধারপাত্র বাবু অভয়পদ মুখার্জী পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতা করে তিনি যে অর্থ পেতেন তা অন্য গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের দান করতেন।

ইলা মিত্রঃ যশোরের বাগুটিয়া গ্রামে আদি নিবাস হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। কলকাতা থেকে লেখাপাড়া শেষ করে তিনি ১৯৪৫ খ্রিঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে আসেন রমেন মিত্রের বধু হিসেবে। ১৯৪৭-৫০ খ্রিঃ নাচোলে অনুষ্ঠিত তেভাগা আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। এজন্য আজও তাঁর কথা মনে রেখেছে এখানকার আবাল-বৃদ্ধ বনিতা।
ইলা মিত্র এক সংগ্রামী নাম। এক বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধির নাম। এক মানবতাবাদী নারীর নাম। যিনি সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বেচ্ছায় জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। তবুও থেমে যায়নি তাঁর আদর্শের লড়াই। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে গেছেন সংগ্রামী এই নারী। শত অত্যাচার নীরবে সহ্য করে গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন।

রফিকুন্নবী(র, নবী): চিত্রশিল্পে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পিছিয়ে থাকলেও এ জেলার কৃতী সন্তান রফিকুন্নবী (রনবী নামে পরিচিত) শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও খ্যাতিও সম্মান লাভ করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোবরাতলা গ্রামে ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণকারী ‘টোকাই’র স্রষ্টা রনবী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। বাবা রশীদুন নবী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা আনোয়ারা বেগম ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। ১৯৭৮ সাল থেকে টোকাই কার্টুন নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। তাঁর ‘টোকাই’ আজ দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের পক্ষ থেকে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে আসছে।